ইসলামী শাসনব্যবস্থা বনাম গণতন্ত্র: একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ - Know about our Bangladesh

ইসলামী শাসনব্যবস্থা বনাম গণতন্ত্র: একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ

### **ভূমিকা**

গণতন্ত্র আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি প্রধান মডেল হিসেবে গৃহীত হলেও, এর কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, কুরআন ও হাদিসে শাসনব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ওপর ভিত্তি করে। এই রিপোর্টে গণতন্ত্রের কুফল এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্লেষণ করা হবে। এটি তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত:  

1. কুরআন ও হাদিসের আলোকে শাসনব্যবস্থা।  

2. গণতন্ত্রের কুফল: আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।  

3. ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে গণতন্ত্রের তুলনা।  


---


### **১. কুরআন ও হাদিসের আলোকে শাসনব্যবস্থা**


ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌমত্ব আল্লাহর হাতে (আল-হাকিমিয়্যাহ), এবং শরীয়াহ (কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক আইন) হলো প্রধান ভিত্তি। এখানে শাসক বা সরকারের ভূমিকা হলো আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা, জনগণের ইচ্ছার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়।


**কুরআনের রেফারেন্স**  

- সূরা আল-ইমরান (৩:১৫৯):  

  _"আর তাদের (মুমিনদের) সাথে পরামর্শ করো তোমার বিষয়ে। তারপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।"_  

  এই আয়াতে শূরার (পরামর্শ) গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা গণতন্ত্রের সাথে আংশিক সাদৃশ্য রাখলেও, এটি আল্লাহর আইনের অধীন।  


- সূরা আশ-শূরা (৪২:৩৮):  

  _"এবং যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয় এবং নামায কায়েম করে, আর তাদের বিষয়াদি পরস্পরের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।"_  

  এখানে শাসনব্যবস্থায় পরামর্শের গুরুত্ব এবং জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।  


- সূরা আল-মায়িদাহ (৫:৪৪):  

  _"যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।"_  

  এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শাসনব্যবস্থা অবশ্যই আল্লাহর আইনের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে।  


**হাদিসের রেফারেন্স**  

- সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৭১৯৮:  

  আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: _"তোমরা আমার পরে কোনো নবী পাবে না, তবে খলিফা পাবে।"_  

  এই হাদিসে খিলাফত ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যা ইসলামী শাসনের ভিত্তি।  


- সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৮৪৭:  

  _"যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করে, সে আল্লাহর আনুগত্য করে। আর যে আমার অবাধ্যতা করে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করে।"_  

  এই হাদিসে শাসনকর্তার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।  


**ইসলামী শাসনব্যবস্থার মূলনীতি**  

ইসলামী শাসনব্যবস্থা নিম্নলিখিত নীতির ওপর ভিত্তি করে:  

1. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব: শাসনক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর, এবং মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।  

2. শূরা (পরামর্শ): শাসনকার্যে জনগণের মতামত গ্রহণ করা।  

3. ন্যায়বিচার: সকলের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।  

4. আইনের শাসন: কুরআন ও সুন্নাহর আইন প্রয়োগ।  


### **২. গণতন্ত্রের কুফল: আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ**


গণতন্ত্র, যদিও জনগণের অংশগ্রহণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা এবং কুফল রয়েছে। আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণের আলোকে নিম্নলিখিত কুফলগুলো উল্লেখযোগ্য:  


**জনগণের ইচ্ছার অপব্যবহার**  

গণতন্ত্রে শাসনক্ষমতা জনগণের হাতে থাকলেও, এটি প্রায়শই অপব্যবহৃত হয়। জনগণের অজ্ঞতা বা ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভোট দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। পপুলিস্ট নেতারা জনগণের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসেন, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের ক্ষতি করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটে ভুল তথ্য এবং আবেগের প্রভাবে জনগণের সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়েছিল।  


**নৈতিক অবক্ষয়**  

গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রাধান্য পায়, যা নৈতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গণতান্ত্রিক দেশে সমকামিতা বা অনৈতিক আচরণকে বৈধ করা হয়েছে, যা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম।  

- কুরআনের রেফারেন্স (সূরা আল-আরাফ ৭:৮০-৮১):  

  _"আর লূতকে (স্মরণ করো), যখন তিনি তার কওমকে বললেন, ‘তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বের কেউ করেনি?’"_  

  এই আয়াতে নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে।  


**সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা**  

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা প্রায়শই বিভক্তি ও অস্থিরতার সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের নির্বাচনের পর সামাজিক বিভেদ এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।  


**অর্থনৈতিক বৈষম্য**  

গণতন্ত্রে প্রায়শই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রভাবে ধনী ও শক্তিশালী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, যা সামাজিক বৈষম্য বাড়ায়। অক্সফামের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১% ধনী ব্যক্তিরা বিশ্বের সম্পদের প্রায় অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে, যা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও প্রকট।  


**ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়**  

গণতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। এটি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ আল্লাহর আইনই সর্বোচ্চ।  

- কুরআনের রেফারেন্স (সূরা আল-বাকারা ২:২১৩):  

  _"মানুষ একটি উম্মাহ ছিল, তারপর আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে, এবং তাঁদের সাথে নাযিল করেছেন কিতাব সত্যের সাথে, যাতে তিনি মানুষের মধ্যে বিবাদমান বিষয়ে ফায়সালা করেন।"_  


আধুনিক বিশ্বে ইসলামী শাসনের প্রয়োগ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

(ক) ইসলামী রিপাবলিক মডেল (ইরান, সৌদি আরব)

  • ইরানে ভিলায়াতে ফকিহ (জurist's guardianship) ব্যবস্থা রয়েছে, যা শরিয়া ভিত্তিক।

  • সৌদি আরবে রাজতন্ত্রের পাশাপাশি উলামায়ে কেরামের পরামর্শমূলক ভূমিকা রয়েছে।

(খ) গণতান্ত্রিক ইসলামী রাষ্ট্র (তুরস্ক, মালয়েশিয়া)

  • তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।

  • মালয়েশিয়ায় ইসলামী আইন ও আধুনিক গণতন্ত্রের সমন্বয়ের চেষ্টা।

(গ) চ্যালেঞ্জসমূহ

  • পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ও সেকুলারিজমের প্রভাব।

  • মুসলিম নেতৃত্বের দুর্বলতা ও স্বার্থপরতা।


### **৩. ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে গণতন্ত্রের তুলনা**


ইসলামী শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর, এবং কুরআন ও সুন্নাহই আইনের উৎস। গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই আইন। ইসলামী শাসনব্যবস্থা শূরা (পরামর্শ) এবং আল্লাহর আইনের অধীন পরিচালিত হয়, যেখানে গণতন্ত্র ভোট ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। ইসলামী শাসনব্যবস্থা কুরআন ও হাদিসের নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে, অন্যদিকে গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর নির্ভরশীল। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সকলের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়, কিন্তু গণতন্ত্রে প্রায়শই ধনী ও শক্তিশালীদের পক্ষে ন্যায়বিচার দেখা যায়।  


**ইসলামী শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব**  

ইসলামী শাসনব্যবস্থা ন্যায়বিচার, সামাজিক সমতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়। উদাহরণস্বরূপ, খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষিত ছিল এবং সমাজে বৈষম্য কম ছিল।  


**গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা**  

গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা প্রাধান্য পায়, যা আল্লাহর আইনের পরিপন্থী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সুদভিত্তিক অর্থনীতি বৈধ, যা কুরআনে নিষিদ্ধ (সূরা আল-বাকারা ২:২৭৫)।  


---


### **উপসংহার**


কুরআন ও হাদিসের আলোকে গণতন্ত্রের কুফলগুলো স্পষ্ট। গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব, নৈতিক অবক্ষয়, এবং সামাজিক অস্থিরতা ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামী শাসনব্যবস্থা আল্লাহর আইনের অধীনে ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করে, যা গণতন্ত্রের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তবে, আধুনিক বিশ্বে ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রয়োগের জন্য সমন্বিত গবেষণা এবং সমাজের প্রস্তুতি প্রয়োজন।  


---


### **তথ্যসূত্র**  

1. কুরআনুল কারীম, সূরা আল-ইমরান (৩:১৫৯), সূরা আশ-শূরা (৪২:৩৮), সূরা আল-মায়িদাহ (৫:৪৪), সূরা আল-আরাফ (৭:৮০-৮১), সূরা আল-বাকারা (২:২১৩, ২:২৭৫)।  

2. সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৭১৯৮।  

3. সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৮৪৭।  

4. অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল, ২০২৩ রিপোর্ট: "Inequality Inc."  

5. সাইয়েদ মওদূদী, *ইসলামী রিয়াসাত*, প্রফেসর খুরশীদ আহমদ কর্তৃক সংকলিত।  

গবেষক: [নজির আহমেদ ]
তারিখ: [২০-০৭-২০২৫]
রেফারেন্স: কুরআন, সহিহ হাদিস, ইসলামী রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের গ্রন্থ (ইবনে তাইমিয়্যাহ, মাওদুদী প্রমুখ)।

No comments

Theme images by TommyIX. Powered by Blogger.